Line – Seven Elements Series
সাতটি দৃশ্যাঙ্গ
ফোটোগ্রাফির একেবারে গোড়ার কথা হল সাত দৃশ্যাঙ্গের কথা। ফোটোগ্রাফিতে ‘কম্পোজিশান’ শব্দটি প্রায় সব্বাই শুনেছেন এবং কিছুদিন ফোটোগ্রাফি চর্চা করলেই ‘কম্পোজিশান’ সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা জন্মায় প্রত্যেকেরই। প্রচলিত ‘কম্পোজিশান’-এর ধারণায় কিছু চিরন্তন পদ্ধতির কথাই বলা হয়ে থাকে বেশিরভাগ আলোচনাতেই। আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে চিরন্তন পদ্ধতির বাইরে ‘কম্পোজিশান’-কে দেখা দরকার। তখনই প্রয়োজন হয় সাত দৃশ্যাঙ্গের ধারণা। দৃশ্যাঙ্গগুলির সঙ্গে খানিক পরিচয় থাকলে ধরাবাঁধা ‘রুল অব থার্ড’ বা ‘লিডিং লাইন’ পেরিয়ে আরো গভীরভাবে ‘কম্পোজিশান’ নিয়ে কাজ করা যায়। শুধু তাই নয় – ‘কনোটেশান’ বা ছবির অন্তর্গত ভাব বা ব্যঞ্জনা তৈরি করতেও এই দৃশ্যঙ্গগুলি অপরিহার্য।
রেখা ▪️ Line
সাতটি দৃশ্যাঙ্গের মধ্যে প্রথম এবং প্রধান হলো রেখা। ছবির মূল কাঠামো তৈরি হয় রেখার মাধ্যমে। বিভিন্ন রূপ ও ধর্ম অনুযায়ী রেখার বহুতর বিভাগ আছে। তবে জ্যামিতিক বা গাণিতিক জ্ঞানে রেখাকে যেমনভাবে দেখা হয় দৃশ্যশিল্পে রেখার বোধ বা ব্যবহার বেশ খানিকটা আলাদা। ফোটোগ্রাফিতে আমরা এমন অনেক রেখা নিয়ে কাজ করি জ্যামিতিক ভাবে যাকে পরিমাপ করা যাবে না। এমনকি দৃশ্যশিল্পের চর্চা না থাকলে সে রেখা হয়তো দেখাও যাবে না। ফোটোগ্রাফিতে অনেক রেখা আমরা কল্পনা করে নিই যেগুলোর বাস্তব জ্যামিতিক অস্তিত্ব নেই।
১/ দৃশ্যমান রেখা (Visible Line)
যে সমস্ত রেখা ছবির মধ্যে সরাসরি দেখা যায় সেগুলো দৃশ্যমান রেখা। এই ধরণের রেখা সাধারণতঃ উজ্জ্বলতার পরিবর্তনের সীমানা ধরে তৈরি হয়। যেমন কোন রাস্তার ধার বরাবর লাইন, বা কোন দেওয়ালের কোন বরাবর লাইন। নিচের ছবিতে দিগন্ত রেখা বরাবর মাঠের শেষে একটি লাইন দেখা যাচ্ছে (দ্বিতীয় ছবিতে হলুদ রেখা)। যে সমস্ত রেখা দেখা যায় না কিন্তু বিশেষ বিশেষ দৃশ্যচরিত্র অনুসারে কল্পনা করে নেওয়া হয় তাদের কল্পিত রেখা বলে। যেমন নিচের ছবিতে বসে থাকা মানুষটির শিরদাঁড়া বরাবর একটি কল্পিত রেখা টানা যেতে পারে (দ্বিতীয় ছবিতে লাল রেখা)। এই দুটি রেখা দিয়ে ছবিটির গঠনগত বিন্যাস বোঝা যায়। দর্শকের দৃষ্টিপথের চলন এই সমস্ত দৃশ্যমান বা কল্পিত রেখা ধরে হতে পারে।
রেখার চরিত্র নিয়ে আর একটু এগোলে দেখা যাবে উপরের ছবির হলুদ ও লাল রেখা দুটি ছবিটিকে চারটি ক্ষেত্রে ভাগ করছে। এইটে রেখার অন্যতম কাজ – ক্ষেত্র বিভাজন। হলুদ রেখাটি ছবিটির উপর নিচে আকাশ ও মাটির সংযোগস্থলে রয়েছে। খেয়াল করলে দেখবেন মাঝখানের একটু নিচ দিয়ে হলুদ রেখাটি তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ আকাশ মাঠের চেয়ে বেশি জায়গা (ক্ষেত্র) জুড়ে আছে। আবার লাল রেখা মানুষটির বসার রেখা অনুযায়ী। এটিও মাঝখান থেকে বেশ খানিকটা বাঁদিকে সরে আছে। এই বিন্যাস দৃশ্যের ভারসাম্যকে ( Visual Balance) নির্ধারণ করে যা ফোটোগ্রাফের অন্যতম চরিত্র।
১/ পৃষ্ঠরেখা (Surface Line)
লাল হলুদ রেখাদুটি যদিও Surface Space বা পৃষ্ঠক্ষেত্র বিভাজন করছে। পৃষ্ঠক্ষেত্র ছাড়াও ফোটোগ্রাফের আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গভীরতাক্ষেত্র বা Depth Space-এর বিন্যাস। গভীরতাক্ষেত্রের বিন্যাস বা নির্মাণ কৌণিক রেখা দিয়ে হয়। নিচের ছবিতে কৌণিক রেখা (দ্বিতীয় ছবিতে নীল রেখা) ছবির সামনের অংশ থেকে পিছনের জানালা পর্যন্ত গভীরতাকে নির্দেশ করছে। যে রেখা ছবির গভীরতাকে অগ্রাহ্য করে কেবল উপর-নিচ বা ডান-বাম দিকে ছবিকে ভাগ করে তাদের পৃষ্ঠরেখা বলে। যে সমস্ত রেখা ছবির গভীরতা নির্দেশ করে তাদের গভীরতা রেখা বলে। পৃষ্ঠরেখা এবং গভীরতা রেখা দৃশ্যমান অথবা কল্পিত দুইই হতে পারে। তবে গভীরতা রেখা মুলতঃ কৌণিক হয়। গভীরতা রেখা একেবারে উল্লম্ব বা অনুভূমিক হলে ছবির গভীরতার ভাব কমে যায়।
কৌণিক রেখা মূলতঃ গভীরতা বোঝানোর কাজে ব্যবহার হলেও পৃষ্ঠরেখা হিসেবেও কৌণিক রেখার ব্যবহার আছে। পাশ্চাত্যের Baroque এবং Sinister রেখার ধারণা কৌণিক পৃষ্ঠরেখার ওপর তৈরি। অনুভূমিক বা উল্লম্ব রেখার চেয়ে কৌণিক রেখা ছবিকে অনেক বেশি গতিময় করতে পারে। কৌণিক রেখার ওপর দখল জন্মালে দৃশ্যসংস্থান (Visual Composition) অনেকটাই সহজ হয়ে ওঠে।
১/ জ্যামিতিক রেখা / সরল ও বক্র রেখা (Geometric Line / Straight & Curve)
সরল রেখা অর্থাৎ অনুভূমিক, উল্লম্ব ও কৌণিক রেখা এবং বৃত্তের অংশ অর্থাৎ অর্ধবৃত্ত বা আরো ছোট বক্ররেখা জ্যামিতিক রেখার পর্যায়ে পড়ে। এছাড়া আর বাকি যা কিছু রেখা প্রকৃতিতে দেখা যায়, যারা কোন জ্যামিতিক সরল বা বৃত্তিয় আকার মেনে চলে না তাদের জৈব রেখা বলে। খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রকৃতিতে প্রকৃত জ্যামিতিক রেখা নেই। যেমন একটা তাল কিম্বা নারকেল গাছ উল্লম্ব সরল রেখা মনে হয়। কিন্তু তাল, নারকেল বা অন্য কোন গাছই একেবারে জ্যামিতিক সরল রেখায় বাড়ে না। ফলে গাছের উচ্চতা বরাবর উল্লম্ব রেখা আপাতভাবে জ্যামিতিক সরল রেখা মনে হলেও তা আসলে জৈব রেখা। অন্যদিকে মানুষ যে সমস্ত জিনিস তৈরি করে – ঘর বাড়ি আসবাব জানলা দরজা ইত্যাদি সবেতেই জ্যামিতিক সরল বা বক্ররেখা ধরে নির্মাণ হয়। ফোটোগ্রাফিতে জ্যামিতিক রেখা ব্যবহার অপেক্ষাকৃত সহজ এবং সরল। কিন্তু ক্রমশঃ গভীর থেকে গভীরতর ব্যঞ্জনা নির্মাণের দিকে এগোতে থাকলে জৈব রেখার ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়ে।
জ্যামিতিক রেখার তুলনায় জৈব রেখা অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। তার মূল কারণ জ্যামিতিক রেখা স্বভাবগত ভাবেই নির্দিষ্ট আকার বহন করে। অন্যদিকে জৈব রেখা যে কোন সময় যে কোন দিকে বাঁক নেয়। ফলতঃ জৈব রেখা অনুভব ও প্রয়োগ বেশ অনুশীলনসাপেক্ষ। জ্যামিতিক রেখা প্রথম স্তরে দৃশ্য ভারসাম্য তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করলেও ফোটোগ্রাফির একটু গভীরতায় পৌঁছলে জ্যামিতিক রেখার নির্দিষ্টতা দৃষ্টি এবং অনুভবকে এক ধরণের সীমার বাইরে বেরোতে দেয় না। সে জায়গায় জৈব রেখা বুনিয়াদী জ্যামিতিক নির্মাণের পেরিয়ে আরো মুক্ত হয়ে উঠতে পারে। সাহিত্যে চিরায়ত বৃত্তছন্দ এবং মুক্তছন্দের চরিত্র অনেকটা জ্যামিতিক এবং জৈব রেখার চরিত্রের সঙ্গে তুলনীয়। মুক্তছন্দের মধ্যে যে অন্তর্লীন ছন্দবোধ জৈব রেখার মধ্যে জ্যামিতিক বোধ তেমনই অন্তর্লীন।
রেখার ধর্ম
রেখার কাজ মূলতঃ তিন ধরণের এবং এই কাজগুলি রেখার আত্মিক ধর্ম বলা যেতে পারে। যে কোন রেখাই এই তিনটি ধর্ম যেকোন অবস্থাতেই মেনে চলে। ফোটোগ্রাফারের জ্ঞানতঃ বা অজ্ঞানতঃ যে কোন ছবিতে রেখা তার কাজগুলো করে চলে।
১/ বিন্দু সংযোগ (Point Connection)
জ্যামিতিক ধারণায় রেখা আসলে অনেক বিন্দুর সমষ্টি। এই বোধ থেকে রেখার প্রথম কাজ সংযোগের ধারণা। একটি রেখা, তার গতিপথে অসংখ্য বিন্দুকে সংযুক্ত করে। এই বিন্দুগুলি রেখার প্রান্তীয় অবস্থানে থাকতে পারে বা রেখার গতিপথের মধ্যবর্তী যে কোন অবস্থানে থাকতে পারে। উপরের ছবিতে গভীরতা রেখা (লাল রঙের রেখা) কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিন্দুকে যেমন দুটি চরিত্রের চোখ এবং হাতে ধরা পানীয় ও খাদ্যকে একই রেখায় সংযুক্ত করে। ফোটোগ্রাফিতে এই বিন্দুগুলোকে আকর্ষণ বিন্দু (Point of Interest) বলে। ছবিতে হলুদ বিন্দুগুলো কয়েকটি প্রধান আকর্ষণ বিন্দু। দৃশ্য চরিত্র নির্মাণ এবং তাদের অন্তর্বর্তী সম্পর্ক নির্মাণের ক্ষেত্রে আকর্ষণ বিন্দু অনুসারে রেখার সংযোগ ধর্ম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সংযোগের ধারণা পরিষ্কার হলে বোঝা যায় যে রেখার সংযোগ বিন্দু গুলোর মধ্যে দৃষ্টি পথ অনুযায়ী এক ধরনের গতি অনুভব করা যায়। পরিষ্কার করে বললে এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দু দেখার দৃষ্টিপথ অনুযায়ী এই গতি অনুভূত হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই গতি থাকলে তার অভিমুখ থাকবে। ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে রেখার এই অভিমুখের ধরন দু’রকম। আমাদের বাম থেকে ডান দিকে পাঠের অভ্যাস রেখার গতিকে প্রভাবিত করে। আবার দৃশ্য চরিত্রের আয়তন (Scale) ও তীব্রতা (Intensity) অনুযায়ী গতির অভিমুখ তৈরি হয়।
শেষ কথা
রেখার অনুভব ও প্রয়োগ ফোটোগ্রাফি চর্চায় অনিবার্য। ক্রমাগতঃ অনুশীলনের ছাড়া রেখার অনুভব আয়ত্ব করা যায় না এ বলাই বাহুল্য। ফোটোগ্রাফিতে কম্পোজিশান শব্দটা খুব পরিচিত। আসলে কম্পোজিশান বলতে আরো গভীর অর্থে দৃশ্যসংহতি (Visual Harmony) বোঝায়। রেখা দৃশ্যসংহতি নির্মাণে মূল উপাদান। রেখার সঙ্গে অন্যান্য দৃশ্যাঙ্গ যেমন উজ্জ্বলতা (Value) বা ক্ষেত্র (Space) সরাসরি জড়িত। রেখার ব্যবহার যেমন ক্ষেত্রবিভাজনকে প্রভাবিত করে তেমনি উজ্জ্বলতার ব্যবহার রৈখিক নির্মাণকে প্রভাবিত করে। রেখার প্রাথমিক ধারণা পোক্ত হওয়ার পর তাই উজ্জ্বলতা এবং ক্ষেত্র কে সঙ্গে নিয়ে রেখার অনুশীলন দরকার পড়ে। এই তিন দৃশ্যাঙ্গের সংহতির অনুভব এবং প্রয়োগ খানিক বুঝতে পারলে জ্যামিতিক রেখা বেশ খানিকটা আয়ত্বে আসতে পারে। জ্যামিতিক রেখা আয়ত্বে আসার পর ধীরে ধীরে জৈব রেখার রেওয়াজের দিকে এগোনো যায়। উজ্জ্বলতা বা ক্ষেত্র ছাড়াও রেখার সঙ্গে আকার (Shape) এবং আকৃতির (Form) সম্পর্কও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ফোটোগ্রাফিতে আকার এবং আকৃতি ভাবব্যাঞ্জনা (Connotation) নির্মাণে সরাসরি সহায়তা করে। পরিণত দৃশ্যনির্মাণে একেবারে বুনিয়াদী স্তর থেকে সামগ্রিক ফোটোগ্রাফ হয়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াতেই রেখা প্রায় অবিসংবাদী মূল দৃশ্যাঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়।